অমরত্বের ইতিবৃত্ত: শেষকথা
Apr 26, 2025 | 95
আমরা এই বইয়ের শুরুতে মানুষের আয়ুষ্কালের ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণ আলোচনা করেছি। সেই ১৯০০ সাল থেকে আয়ুষ্কালের ক্রমাগত বৃদ্ধি স্বভাবতই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগাচ্ছে— চিকিৎসা বিজ্ঞানের আবিষ্কার কি আমাদেরকে অমরত্বের স্বাদ প্রদান করতে পারবে? বিংশ শতাব্দীতে অ্যান্টিবায়োটিক, টিকা ও ডিএনএ’র আবিষ্কার আমাদের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির গবেষণাকে বেগবান করেছে। মধ্যযুগের মতো ব্যাকটেরিয়া কিংবা ছত্রাকের আক্রমণে আজকাল খুব বেশী মানুষ মারা যায় না (কোভিডের ব্যাপারটি একটু ব্যতিক্রম বলে বিবেচনায় আনছি না)। তারপর দ্বিতীয় অধ্যায়ে এসে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের নতুন শত্রু ‘বার্ধক্য’ সম্পর্কে। বয়সের সাথে সাথে আমাদের ডিএনএ-তে মিউটেশন জমা হয়, টেলোমিয়ার ক্ষয় হয় এবং স্টেমসেলের সঞ্জীবনী শক্তি হ্রাস পায়। এর ফলশ্রুতিতে একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা প্রধানত ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও আলজেইমারের মতো রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছি। সুতরাং, মানুষের আয়ুষ্কালকে যদি এখন ৭০ বছরের কোটা পার করে ১০০’র ঘরে নিতে হয় তাহলে বার্ধক্যকে বশে আনা শিখতে হবে।
তৃতীয় অধ্যায়ে এসে আমরা জেনেছি বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে। আমরা দেখেছি ইঁদুরের উপর গবেষণা করে কেন বার্ধক্যের সমাধান আবিষ্কার করা বেশ কঠিন। তারপর পিটো’স প্যারাডক্স এবং বিবর্তনের জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে আমরা পাঁচটি প্রাণী সম্পর্কে গভীরভাবে জানার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। নেকেড মোল র্যাট, হাতি, তিমি, কচ্ছপ এবং কুমির— এই পাঁচটি প্রাণীর প্রত্যেকে অনেক দিন পর্যন্ত বাঁচে এবং তাদের ক্যান্সার ও বার্ধক্যজনিত জটিলতা অপেক্ষাকৃত কম হয়।
চতুর্থ থেকে অষ্টম অধ্যায়ের প্রতিটিতে আমরা জেনেছি এই প্রাণীগুলোর ক্যান্সার কিংবা বার্ধক্যকে হারানোর গল্প। কেবলমাত্র গবেষণাপত্রের জটিল গ্রাফে বাঁধা পড়ে না থেকে আমরা আলোচনাটিকে নিয়ে গিয়েছি বিজ্ঞানীদের জীবনের গল্পে। আফ্রিকার মরুভূমির নেকেড মোল র্যাট ও জঙ্গলের হাতি, আলাস্কার সমুদ্রের বোহেড তিমি, সিশেলস্-এর বৃহৎ কচ্ছপ এবং থাইল্যান্ডের কুমিরের উপর গবেষণার গল্প থেকে আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি কীভাবে বিবর্তন আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে বার্ধক্যকে হারানোর মন্ত্র লুকিয়ে রেখেছে। আগামী তিন দশকে বিজ্ঞানীদের মূল চ্যালেঞ্জ হবে বার্ধক্যকে পরাজিত করার এই সকল রহস্য উদঘাটন করে তা মানুষের দেহে প্রয়োগ করা। বর্তমান গবেষণার ধারা ঠিকমত বজায় থাকলে এই শতাব্দীতেই হয়তো আমরা বার্ধক্য থেকে বেঁচে থাকার জন্য ভ্যাকসিনের সন্ধান পেয়ে যাবো। হয়তো সেসময়ে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল গিয়ে ঠেকবে একশতে। সেটা শুধু মানুষ নয় বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্যও সেঞ্চুরি!
প্রাচীন পুরাণে সুমেরিয়া অঞ্চলের উরাক প্রদেশের রাজা গিলগামেশের গল্প রয়েছে। ‘এপিক অফ গিলগামেশ’-এর ভাষ্যমতে, রাজা গিলগামেশের প্রতিদ্বন্দী হিসেবে ইশ্বর ইনকিডু নামক চরিত্রকে সৃষ্টি করলেন। কিন্তু, ইশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে গিলগামেশ আর ইনকিডু নিজেদের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে এবং একত্রে মিলে তারা হুমবাবা নামক দৈত্যকে পরাজিত করে। হুমবাবার এহেন মৃত্যুতে ইশ্বর প্রচন্ড রেগে গেলেন এবং তিনি ইনকিডুকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করলেন। নিজের প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে গিলগামেশ তখন প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়লেন। হঠাৎ তিনি জানতে পারলেন ‘লাইসিয়াম’ নামক ফুলের কথা যা মৃত মানুষকে পুনর্জীবিত করতে পারে। গিলগামেশ তখন বন্ধু ইনকিডুর জীবন ফিরিয়ে আনতে লাইসিয়াম তথা অমরত্বের খোঁজে বেরিয়ে গেলেন।
অজানা পথে পাহাড়-পর্বত-দৈত্য-দানব পরাজিত করে গিলগামেশ চললেন লাইসিয়ামের সন্ধানে। পথিমধ্যে নানা রকম বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে তিনি শিখলেন তার জীবনের অন্যতম কঠিন সত্য— ‘আমাদের জীবনের লক্ষ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জনের পথটাও একই সমান গুরুত্ববহন করে।’ অবশেষে বছরের পর বছর ধরে পথ পাড়ি দিয়ে গিলগামেশ সন্ধান পেলেন অমরত্বের রসধারী ‘লাইসিয়াম’ ফুলের। তিনি চিন্তা করে দেখলেন, তার বন্ধুর পাশাপাশি উরাক অঞ্চলের মানুষও এই ফুলের মাধ্যমে দীর্ঘ জীবনের স্বাদ অর্জন করতে পারবে। তাই, রাজা গিলগামেশ তখন ফিরে যেতে থাকলেন তার রাজ্যের মানুষের কাছে। উরাক প্রদেশের ঠিক বাহিরে পৌঁছে একদিন গিলগামেশ তাবুতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ করে বিশাল একসাপ এসে তার লাইসিয়াম ফুলটি খেয়ে ফেললো। গিলগামেশ ছুটলেন সেই সাপের দিকে। যত বারই তিনি সাপটি ধরে ফেলেন ততবারই সাপটি চামড়া বদলে হাত ফসকে বের হয়ে যায়। যত বারই গিলগামেশ সাপটি মেরে ফেলেন, ততবারই সাপটি আবার যৌবন বয়সে পুনর্জন্ম লাভ করে। গিলগামেশ বুঝতে পারলেন, তিনি অমরত্বের চাবিকাঠিটি হাতে পেয়েও হারিয়ে ফেলেছেন। অমরত্ব না পেলেও গিলগামেশ তার সফর থেকে অনেকগুলো জীবন বদলে দেয়া শিক্ষা পেয়েছেন যা পরবর্তীকালে ‘এপিক অফ গিলগামেশ’ নামক মহাকাব্যে বর্ণিত হয়েছে।
রাজা গিলগামেশ অমরত্বের সন্ধান না পেলেও আমাদের আজকের যুগের বিজ্ঞানীরা কিন্তু দমে থাকার পাত্র নয়। বার্ধক্যকে পরাজিত করার সূত্রগুলো একের পর এক তারা সমাধান করে চলেছেন। বিজ্ঞানের এই যাত্রা অব্যাহত থাকলে এই শতাব্দীতেই আমরা হয়তো হাতে পেয়ে যাবো গিলগামেশের সেই ‘লাইসিয়াম’ ফুল।
জয় বিজ্ঞানের জয়!
———————————————————————————
সূচিপত্র:
- পূর্বকথা
- আমাদের আয়ুষ্কালের ইতিহাস
- বুড়ো জীবনের যতো সমস্যা
- প্রকৃতির মাঝে অমরত্বের সন্ধান
- মরুভূমির অমর প্রাণী
- ঐরাবতের বিবর্তনে বাজিমাত
- দু’শো বছরের তারুণ্য
- ধীর গতির সেঞ্চুরিয়ান
- নর্দমার ফিনিক্স
- শেষকথা
———————————————————————————
ই-বইটি পড়ে ভালো লেগে থাকলে লেখক ও প্রকাশকের কথা চিন্তা করে অনুগ্রহপূর্বক বইটির কপি সংগ্রহ করুন এই লিংক থেকে: রকমারি.কম
গ্রন্থপঞ্জি
- Cagan, Alex, et al. "Somatic mutation rates scale with lifespan across mammals." Nature 604.7906 (2022): 517-524.
- Peto, R., et al. "Cancer and ageing in mice and men." British journal of cancer 32.4 (1975): 411-426.
- Montazid, Shamir, et al. "Adult stem cell activity in naked mole rats for long-term tissue maintenance." Nature Communications 14.1 (2023): 8484.
- Simonson, Tatum S., et al. "Genetic evidence for high-altitude adaptation in Tibet." Science 329.5987 (2010): 72-75.
- Buffenstein, Rochelle, and Jennifer UM Jarvis. "The naked mole rat--a new record for the oldest living rodent." Science of Aging Knowledge Environment 2002.21 (2002): pe7-pe7.
- Kim, Eun Bae, et al. "Genome sequencing reveals insights into physiology and longevity of the naked mole rat." Nature 479.7372 (2011): 223-227.
- Tian, Xiao, et al. "High-molecular-mass hyaluronan mediates the cancer resistance of the naked mole rat." Nature 499.7458 (2013): 346-349.
- Zhang, Z., Tian, X., Lu, J.Y. et al. “Increased hyaluronan by naked mole-rat Has2 improves healthspan in mice.” Nature 621, 196–205 (2023).
- Sulak, Michael, et al. "TP53 copy number expansion is associated with the evolution of increased body size and an enhanced DNA damage response in elephants." elife 5 (2016): e11994.
- Firsanov, Denis, et al. "DNA repair and anti-cancer mechanisms in the longest-living mammal: the bowhead whale." BioRxiv (2023): 2023-05.
- Quesada, Víctor, et al. "Giant tortoise genomes provide insights into longevity and age-related disease." Nature ecology & evolution 3.1 (2019): 87-95.
- Pata, Supawadee, et al. "Characterization of the novel antibacterial peptide Leucrocin from crocodile (Crocodylus siamensis) white blood cell extracts." Developmental & Comparative Immunology 35.5 (2011): 545-553.
- Siddiqui, Ruqaiyyah, et al. "Longevity, cellular senescence and the gut microbiome: Lessons to be learned from crocodiles." Heliyon 7.12 (2021).