আর্ডভাক, সাভানা, প্রেটোরিয়া
Travel Stories

আর্ডভাক, সাভানা, প্রেটোরিয়া

May 27, 2020   |    6532


আমার পিএইচডি গবেষণার বিষয়বস্তু হলো বুড়ো হয়ে যাবার সাথে সাথে স্টেম সেলে কী ধরণের পরিবর্তন আসে তা বের করা। এধরণের গবেষণার জন‍্য সবচেয়ে উত্তম মডেল হলো ন‍েইকেড মোল র‍্যাট নামক এক অদ্ভূত ইঁদুর। ৩০ গ্রাম ওজনের লোম বিহীন এই প্রাণীটা বাচেঁ প্রায় ৩২ বছর পর্যন্ত; এখন পর্যন্ত তাদের খুব বেশী ক‍্যান্সার ধরা পড়েনি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে যে রোগগুলো জেঁকে বসে সেগুলোও নেইকেড মোল র‍্যাটে বিরল। কিন্তু, সমস‍্যা হলো অক্সফোর্ডে কোন নেইকেড মোল র‍্যাট নেই। এদের বাস আফ্রিকায়।


কি আর করার?  


২০১৯ সালের ১৬ জুন কাতার এয়ার লাইনের এক ১৪ ঘন্টার ফ্লাইটে চড়ে লন্ডন থেকে সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ আর টাম্বো এয়ারপোর্টে এসে নামলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইট ছিলো এটি। এই ট্রিপের আগের এক মাস আমি রীতিমতো পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, আফ্রিকায় আমার কাজ করতে হবে ফিল্ড জুওলোজিস্টদের সাথে। তাদের কাছে মলিকুলার বায়োলজির কোন ল‍্যাব নেই বললেই চলে। তাই, আমি অক্সফোর্ড থেকে পুরোটা ল‍্যাবকে প‍্যাক করে আফ্রিকায় পার্সেল করেছি। এই কাজ করার জন‍্য বিগত ছয়মাস ধরে নিখুঁত প্ল‍্যান করতে হয়েছে। 


১৭ জুন বিকাল তিনটায় আফ্রিকা মহাদেশে আমার প্রথম পদচিহ্ন পড়লো। It’s a small step for a man, a big leap for ageing research. আমি কাজ করবো প্রেটোরিয়া বিশ্ববিদ‍্যালয়ে। আমার রিসার্চ পার্টনার ড‍্যানিয়েল এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে আসলো। ইমিগ্রেশন থেকে বের হতেই চোখে পড়লো সাড়ে ছয়ফুট লম্বা বাদামী চুলের বৃহদাকার এই সাউথ আফ্রিকানকে। হাই-হ‍্যালোর সামাজিকতা বাদ দিয়ে ড‍্যানের সরাসরি প্রশ্ন, “শামীর, তুমি বিয়ার আর মাংস খেতে পছন্দ করো?”


পোড়া মাংস আমার প্রিয় খাবার। সেটা গলা দিয়ে নামাতে আমার দরকার অনন্ত দুই পাইন্ট বিয়ার। সুতরাং, এই দুই জিনিস আমি শুধু পছন্দ করি তাই নয়; এদের ছাড়া আমার পক্ষে বাঁচা অসম্ভব।”, আমি উত্তর দিলাম।


ড‍্যান বললো, “ওয়েলকাম টু সাউথ আফ্রিকা। আগের প্রশ্নের উত্তরেনাবললে আমরা কাউকে আমাদের দেশে ঢুকতে দেই না।


সাউথ আফ্রিকানদের বিয়ারপ্রীতির ব‍্যাপারটা ক্রিকেট খেলার গ‍্যালারীতে তাদের হাতে ধরে রাখা বাদামী বর্ণের গ্লাসের আধিক‍্য থেকেই আপনার বুঝতে পারার কথা। বিয়ার, রাগবী আর ব্রাই (বার-বি-কিউ) ছাড়া সাউথ আফ্রিকান রবিবারের কথা চিন্তাই করা যায় না।


ড‍্যান তার ফোর হুইলার চালিয়ে আমাকে জোহানেসবার্গ থেকে প্রেটোরিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে। হাইওয়ের দুই ধারে শুধু খালি মাঠ। মজার ব‍্যাপার হলো, দক্ষিণ গোলার্ধের এই দেশে জুন মাস হলো তীব্র শীতকাল! অথচ আফ্রিকান এই শীতকাল ইংল‍্যান্ডের সেরা গ্রীষ্মকাল থেকেও বেশী রোদেলা। 


সন্ধ‍্যা সাড়ে ছয়টায় প্রেটোরিয়ার গাওটেং অঞ্চলের হ‍্যাটফিল্ড এলাকায় বিশ্ববিদ‍্যালয়ের নিজস্ব গেস্ট হাউসে ড‍্যান আমাকে নিয়ে গেলো। একটু হতাশা ভরা কন্ঠ নিয়ে সে বললো, “আমি পোস্টডক হিসেবে কাজ করেও এমন বাসায় থাকতে পারি না, শামীর!”


ড‍্যান কি বোঝাতে চাইছিলো তা আমি একটু পরেই আন্দাজ করতে পারলাম। বিশ্ববিদ‍্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে থাকার জন‍্য তিন বেড রুমের এক আলিশান ডুপ্লেক্স অ‍্যাপার্টমেন্ট দিয়েছে। এর মাসিক ভাড়া অক্সফোর্ডের একটি রুমের ভাড়ার থেকেও কম! জায়গাটার প্রতিটা কোণা ঝকঝকে তকতকে। ড‍্যান আমাকে বললো, “তুমি এখানে এসেছো সায়েন্স করতে। ঘর গোছানো, প্লেট ধোয়া তোমার কাজ না। ঘুম থেকে উঠে সোজা ল‍্যাবে চলে আসবে। রাতে ফেরত এসে দেখবে আবার সব পরিষ্কার হয়ে গেছে!” 


আমি এই রাজকীয় আপ‍্যায়নে ইতোমধ‍্যে বেশ অবাক। দোতলার রুম দুটো একটু ছোট; আমি নীচতলার রুমের নিজের লাগেজ রেখে ড‍্যানের সাথে খেতে চলে গেলাম। সে আমাকে নিয়ে গেলো Capital Craft Menlo Park-এ। পাবের বাহিরে খোলা আকাশের নীচে অনেকগুলো টেবিল চেয়ার রাখা; প্রতিটার পাশে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সামনে বড় একটা টিভি পর্দায় রাগবী খেলা দেখা যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম, এটাই সাউথ আফ্রিকার সবচেয়ে শক্তিশালী কালচাররাগবী, মাংস, বিয়ার। 


মেন‍্যুটা হাতে নিয়ে আমি খাবারের অপশন দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। এদের বার্গার আছে প্রায় ২৫ ধরণের; বিয়ার গোটা ৫০ এর মতো! ক‍্যাসেল লাইট হলো সাউথ আফ্রিকার জাতীয় বিয়ার। সেটার এক পাইন্টের সাথেনো ব্রোনামক এক বার্গার অর্ডার করলাম। তাদের সংস্কৃতিতে এক পাইন্ট বিয়ার শেষ না করা পর্যন্ত কোন খাবার সার্ভ করা হয় না! আমি আর ড‍্যান এক ঢোকে পাইন্টটা নামিয়ে দিয়ে আমাদের বার্গারটা আনলক করলাম।


আমেরিকান খাবারের সাইজ অনেক বড় হয় বলে বিশ্বজুড়ে একটা সুনাম আছে। যারা এটাতে বিশ্বাস করে তাদের আমি ধরে ধরে সাউথ আফ্রিকা নিয়ে যেতে চাই। আমাদেরকে যে বার্গারটা সার্ভ করা হলো তার ওজন প্রায় ৮০০ গ্রাম। পুরো বার্গারটা হাতে ধরে রাখা সম্ভব না। দুটো বিশাল বড় বীফ প‍্যাটির মাঝে অনেক বড় একটা ড‍্যানিশ ফেতা চীজের আস্তরণ। উপরে কিছু পেয়াজের রিং আর হানি মাস্টার্ড সস। এখন পর্যন্ত জীবনে যত বার্গার খেয়েছি, নি:সন্দেহে এটাই সেরা। সাথে সাথে কেন সাউথ আফ্রিকানদের দেহ এতোটা বিশাল হয়ে থাকে তাও  আন্দাজ করতে পারলাম।


খাবার শেষে আরো এক পাইন্ট ক‍্যাসেল লাইট নিয়ে বিলটা দেখতেই আমি আরেকটা বড় ধাক্কা খেলাম। এই বার্গারের দাম মাত্র ৪০০ টাকা!!! প্লেন থেকে নামার মাত্র ঘন্টার মাথায় আমি মনে মনে আফ্রিকান হয়ে গেলাম। যতই হোক আফ্রিকার প্রতি মানব সভ‍্যতার টানটা বেশ প্রবল। একে বিবর্তনবাদীরা “The mitochondrial motherland” বলে থাকে!


১৪ ঘন্টার ফ্লাইট পার করে আসলেও আমি মাত্র এক ঘন্টার টাইমজোন অতিক্রম করেছি। কারণ ম‍্যাপের ওপর প্রেটোরিয়া অক্সফোর্ডের ঠিক নীচে খানিকটা ডান দিকে অবস্থিত। তাই, জেটল‍্যাগ আমাকে তেমনটা পেয়ে বসেনি। রাতে সুন্দর একটা ঘুম দিয়ে পরদিন থেকে বিশ্ববিদ‍্যালয়ে প্রবেশাধিকার পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলাম।


নিরাপত্তা নি:সন্দেহে সাউথ আফ্রিকার একটা বড় ইস‍্যু। এখানে ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো বিভেদটা বেশ চরম। প্রতিটা বাড়ির চারদিকে বড় বড় দেয়াল; সেই দেয়ালের উপর আছে ইলেকট্রিক ফেন্স। সদর দরজায় ম‍্যাগনেটিক কার্ড আর ফিংগার প্রিন্ট উভয়ের কম্বিনেশন একসাথে প্রয়োগ করতে হয়। সুতরাং, কারো আঙ্গুল কেটে নিয়ে আসলেও ডাকাতরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। বিশ্ববিদ‍্যালয়ের আশপাশের এলাকাটা হলো গ্রীন জোন; সেখানে হেঁটে বেড়ানোটা কিছুটা নিরাপদ। তবে, সত‍্যি কথা বলতে, আমি কাউকে রাস্তায় হেঁটে যেতে দেখিনি। সবাই উবার ডেকে গাড়ির ভেতরে করে ঘুরে বেড়ায়। আমি একদিন রাত্র আটটায় মুদি দোকান থেকে বাজার করে ফিরছিলাম। পথিমধ‍্যে তিনজন জুলু ভদ্রলোক এসে আমাকে ঠান্ডা ভাষায় মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আমার সব খাবার নিয়ে গেলো। আমার সাথে থাকা মোবাইল ফোনটা তারা কেন নিয়ে গেলো না তা আমার বোধগম‍্য হলো না। ড‍্যানের ভাষ‍্যমতে, মোবাইল নিলে পুলিশে ধরা খাবে; তাদের প্রয়োজন শুধু খাবার। তাই খাবার দিয়ে দিলেই তারা খুশি থাকে। সমাজের এই ভীষণ ধনী-দরিদ্র বিভাজন দেখে আমি বড় আশাহত হয়েছিলাম। জোহানেসবার্গে নাকি ছিনতাই করার সময় সবাইকেই ছুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়। তাই সাউথ আফ্রিকায় মার্ডারের সংখ‍্যা ছিনতাইয়ের চেয়ে বেশী! অবস্থা থেকে বের হতে না পারলে সাউথ আফ্রিকার জন‍্য ভবিষ‍্যতে টিকে থাকাটাই হয়তো দুষ্কর হয়ে যেতে পারে।


আগেই বলেছিলাম অক্সফোর্ড থেকে আমার ল‍্যাবটাকে পার্সেল করে আমি সাউথ আফ্রিকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। দু:খের ব‍্যাপার হলো, আমি চলে আসলেও আমার পার্সেল আটকে আছে কাস্টমসে। সুতরাং, প্রথম দুইদিন কোন কাজই শুরু করা গেলো না। ১৯ জুন শুকবার সকালে ড‍্যান আমাকে বললো, “শামীর, লেটস গো টু দ‍্য বুশ।


সোজা বাংলায় এর মর্মার্থ হলো, চলো আফ্রিকান সাভানায় তোমাকে নিয়ে যাই। ড‍্যানের মাস্টার্স স্টুডেন্টরা আর্ডভাক নামক এক বিশাল পতঙ্গভূক স্তন‍্যপায়ীর উপর গবেষণা করছে। আর্ডভাক নিয়ে গবেষণায় এরা পৃথিবীর সেরা। আজ রাতে তারা বেশ কিছু আর্ডভাক জঙ্গল থেকে ধরতে যাচ্ছে। আমাকেও সেই সফরে তাই আমন্ত্রণ জানানো হলো। শর্ত একটাই, ভয় পাওয়া যাবে না।


বাঞ্জি জাম্প, শার্ক ডাইভ করে আসা এই আমি মুহুর্তেই শরীরের শিরা-উপশিরায় খানিকটা এড্রেনালিন ছড়িয়ে দিয়ে বলে ফেললাম, “হেল ইয়েস!” 


ব‍্যস! শুরু হয়ে গেলো আমার লাইফেরডেভিড এটেনব্রোহ এক্সপেরিয়েন্স


বেলা একটা নাগাদ আমাদের ফোর হুইলারের ভেতরে অনেক শুকনো খাবার, দুই ডজন বিয়ার, চারটা স্নেক-বাইট কীট, গাম বুট, বালতি, গজ কাপড় নিয়ে রওনা হলাম বতসোয়ানা বর্ডারের দিকে। চারপাশে ঘাসবন; মাটির তৈরি লাল রাস্তা দিয়ে আমাদের ফোর হুইলারটা তার টায়ারের দাগ কেটে যাচ্ছে। সেই দাগ গুনে বলে দেয়া যায়, আজকে সারা দিনে এই রাস্তা দিয়ে মাত্র পাঁচটা গাড়ি চলে গিয়েছে। যারা পর্যটক হিসেবে আফ্রিকান সাভানায় সাফারী করতে আসেন তাদের সাধারণত কয়েকটা রিসোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এই সাহসী জুওলোজিস্টরা তো আর পর্যটক নয়। এরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে আফ্রিকান গহীন জঙ্গলে; যেখানে আমাদের আর্ডভাকের বসবাস।


প্রায় সন্ধ‍্যা সাত-টায় আমরা এলিস্রাস নামক এলাকায় গিয়ে পৌঁছলাম। এই এলাকার মালিক এক ব্রিটিশ-সাউথ আফ্রিকান ভদ্রলোক। ফিলিপ আর তার স্ত্রী কেট আমাদেরকে তাদের গৃহে দুই রাতের জন‍্য থাকার জায়গা করে দিলো। লোকালয় থেকে কয়েকশ মাইল দূরের এই জঙ্গলে কেন আমাদের ব্রিটিশ ভদ্রলোক বাস করেন তা ঠিক বুঝতে পারলাম না।


আগে কাজ, তারপর ফূর্তি। তাই, দেরী না করে ড‍্যানের ছাত্রী মন তার সব যন্ত্রপাতি গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলো। আমরা ঘুটঘুটে অন্ধকারে এখন হেঁটে যাচ্ছি আফ্রিকান ঘাস বনের মধ‍্য দিয়ে। বলাই বাহুল‍্য, এই এলাকায় জাগুয়ার, চিতা, আফ্রিকান কিং কোবরা এবং পাফ অ‍্যাডারের বাস। ড‍্যান বললো, “ভয় নেই। এই জঙ্গলের সবচেয়ে ভয়ানক জানোয়ার আমি।


আর্ডভাককথাটার অর্থ হলোমাটির নিচে বসবাসকারী শুয়োর বিশালাকৃতির এই শান্ত প্রাণীটা অসম্ভব লাজুক প্রকৃতির। ড‍্যানের মতে, আর্ডভাক দেখতে পাওয়াটাই বিশাল বড় ভাগ‍্যের ব‍্যাপার। মন কিছু মাটির ডিবির উপর বড় বড় পায়ের ছাপ দেখে আমাদের জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে যেতে থাকলো। অবশেষে একটা গর্তের উপরের ছাপ দেখে মনে হলো, মাত্র এক ঘন্টা আগে কেউ এইটা খুড়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে। 


শুরু হয়ে গেলো ফাঁদ পাতা। গর্তের মুখে একটা বড় জাল লাগিয়ে দেয়া হলো। সেই জালটা গিয়ে শেষ হবে একটা খাঁচার মধ‍্যে। খাঁচার প্রবেশ মুখে একটা লোহার পাটাতন রয়েছে; খানিকটা ভার দিলেই তা উপর থেকে খাঁচার দরজা বন্ধ করে দেয়। ব‍্যস! এভাবেই আটকা পড়ে যাবে আমাদের আর্ডভাক। মজার ব‍্যাপার হলো, সেই দরজাটা লেগে যাওয়ার সাথে সাথে একটা রেডিও ট্র‍্যাকিং ডিভাইস বার্তা প্রেরণ শুরু করে। কয়েকশ মিটার দূরে গাড়ির ভেতরে আমরা বিশাল বড় একটা অ‍্যান্টেনা ধরে বসে আছি; কখন আসবে সেই মধুর রেডিও বার্তা? যদি জন্তুটা ধরা পরে তবে আমাদের দলের ভেটেনারী চিকিৎসকেরা তার পেট চিরে একটি ট্র‍্যাকিং ডিভাইস লাগিয়ে দিবে। তারপর একমাস ধরে তার গতিবিধি পর্যালোচনা করে আর্ডভাকের জীবনচক্র সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা প্রকাশ করে হবে। 


প্ল‍্যান অনেক সুন্দর। কিন্তু, আফ্রিকার জঙ্গলে প্ল‍্যান কাজ করে না। আমরা প্রায় চার ঘন্টা ধরে বসে আছি গাড়ির ভেতরে। মনের মনে তখন হতাশা। ইতোমধ‍্যে আমি ফিলিপের সাথে গল্প করতে করতে তার জীবন ইতিহাস উদঘাটন করে ফেলেছি। মজার ব‍্যাপার হলো, ফিলিপ অ‍্যাস্ট্রোফিজিক্সের উপর পিএইচডি করেছে অক্সফোর্ড থেকে। আমাকে পেয়ে সে বিশ্ববিদ‍্যালয় জীবনের স্মৃতি রোমন্থনে লেগে গেলো। ২২ বছর বয়সে ফিলিপ কেটের প্রেমে পড়ে সাউথ আফ্রিকায় চলে আসে। তারপর থাকতে শুরু করে এই সাভানার বিশালতার মাঝে। আফ্রিকার আকাশ অসম্ভব পরিষ্কার। সাভানার মাঝে টেলিস্কোপ লাগিয়ে ফিলিপ পর্যবেক্ষণ করেন আমাদের মিল্কি ওয়ে গ‍্যালাক্সিকে। সেরাতে আমি জীবনের প্রথম বারের মতোমুন রাইজদেখতে পেলাম।


ঘুঁট ঘুঁটে অন্ধকার সাভানার দৃষ্টিসীমায় হঠাৎ চাঁদের বুড়ি হাসি দিয়ে উঠলো। আস্তে আস্তে সেই বনটা পরিণত হলো জোৎস্নার রাজ‍্যে। খালি চোখে এর থেকে ভালো তারা দেখার সুযোগ এর আগে আমি কেবল বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন আইল‍্যান্ডেই পেয়েছিলাম। ফিলিপ একে একে তারাদের জীবন রহস‍্য বর্ণণা করা শুরু করলো; আর আমি কিছুক্ষণ পর পর তাকে থামিয়ে করতে থাকলাম হাজারটা প্রশ্ন। একবার চিন্তা করে দেখুন। আপনি আফ্রিকার জঙ্গলে আর্ডভাক ধরার ফাঁদ পেতে এক অক্সফোর্ড অ‍্যাস্ট্রোফিজিসিস্টের সাথে মিল্কি ওয়ে গ‍্যালাক্সী নিয়ে গল্প করতে করতে জীবনে প্রথম বারের মতো মুন রাইজ দেখছেন। 


On that moment, Africa had me.


রাত্র এক ঘটিকা হলো আমাদের ডেড লাইন। কারণ এর পর আর্ডভাক ধরেও কোন লাভ নেই। বাহিরের তাপমাত্রা অনেক কমে যাওয়ায় রাত একটার পর আর্ডভাকের উপর সার্জারী করা সম্ভব নয়। তাই প্রথম রাতে মনের মনকে খানিকটা অভুক্ত রেখেই আমরা বাড়ি ফিরে গেলাম। রুমে জিনিসপত্র রেখে ড‍্যান আমাকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বললো, “Always look into the toilet before you sit. You don’t want a Cobra bite in your bum.” আমি একটু হেসে বলললাম, “Dan, I don’t want Cobra bite in any part of my body. Bum or otherwise.”


সেরাতে আমি বছরের সবচেয়ে শান্তির ঘুম দিয়েছিলাম। সেই ছোটবেলা থেকে আমি বড় হয়েছি আফ্রিকার জঙ্গলে বানানো ডকুমেন্টারি দেখে দেখে। আজ আমি একদল গবেষকদের সাথে সেই আফ্রিকার জঙ্গলেই রাত কাটাচ্ছি। আহ! জীবনটা আমাকে কত যে সুন্দর সুন্দর সুযোগ দিয়েছে তা ভেবে মনে মনে খুবই আনন্দিত হলাম।


পরদিন ঘুম ভাঙলো সকাল সাত-টায়। ড‍্যানকে টেনে নিয়ে আমার ল‍্যাপটপের সামনে বসিয়ে আগামী এক মাসের প্ল‍্যান বুঝাতে লেগে গেলাম। ড‍্যান একটু ভয় পেয়ে বললো, “শামীর, আমি তোমার সাথে প্রেটোরিয়া ফেরত যেতে চাই না।


নাস্তা শেষ করে সবাই মিলে মিটিং বসলাম। ড‍্যান, মন, চারজন ভেট আর আমি। প্ল‍্যান বদলাতে হবে। আমি প্রস্তাব করলাম, “একের বেশী ফাঁদ পাতা হোক।মন আমার কথায় সায় দিলো। ভেটরা বললো তারা দুই ফাঁদের মাঝখানে বসে থাকবে। কোনটাতে আর্ডভাক ধরতে পারলে তাদেরকে মোর্স কোড দিয়ে সিগনাল পাঠাতে হবে। তারা তখন গাড়ি চালিয়ে চলে আসবে। 


আপনি হয়তো ভাবছেন, এই যুগে কেন রেডিও সিগনাল আর মোর্স কোড লাগবে


কারণ, আমরা আছি আফ্রিকান সাভানায়। এখানে কোন মোবাইল সিগনাল নেই; নেই কোন ইমার্জেন্সী সার্ভিস। একবার কিং কোবরার ছোবল খেলে মাত্র ত্রিশ মিনিটের মাঝে নিকটবর্তী গাড়ি থেকে অ‍্যান্টিভেনম ইঞ্জেকশন নিয়ে পুশ করতে হবে। নতুবা আপনাকে আফ্রিকার জঙ্গলেই শেষ নি:শ্বাস ত‍্যাগ করতে হবে। প্রতিটা পা ফেলার আগেই তাই আমাদের একবার দেখে নিতে হয়। মনের কাছ থেকে জানতে পারলাম, সবচেয়ে ভয়ানক হলো পাফ অ‍্যাডার নামক সাপ। তারা হিস হিস করতে করতে আপনার পায়ের কাছ দিয়ে চলে যাবে। মানুষ দেখলে তারা মোটেও ভয় পায় না। 


প্রথম ফাঁদ পাতা হলো গত কালের লোকেশনে। আমি আর মন রেডিও টেস্ট করে নিলাম। ড‍্যান অনেকক্ষণ ধরে গর্তের উপর লাফালাফি করলো। এক পর্যায়ে সে আমাকে গর্তের ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দেখতে বললো কিছু নড়াচড়া করছে কি না। উত্তরে আমি বললাম, “Dan, it’s too early to be drunk.”


বেলা বারোটার সময় আমরা ছুটলাম দ্বিতীয় লোকেশনে। এবার যা দেখতে পেলাম তা বেশ হৃদয় বিদারক এক চিত্র। মাইলের পর মাইল ধরে বনটা আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ফরেস্ট ফায়ার এই সাভানার বড় শত্রু। জঙ্গলের বাতাসে আগুনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ঠিক তখনই ড‍্যান আমাকে ডানদিকে তাকাতে বললো।


আমি মাথা ঘুরিয়ে ডান দিকে চোখ ফেলতেই হতবাক হয়ে গেলাম। এই সেই আফ্রিকার জঙ্গল যা আমি ন‍্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ‍্যানেলে দেখে এসেছি। দিগন্ত বিস্তৃর্ত এই ঘাস বনে এক ঝাঁক ইম্পালা প্রাণপণে ছুটে বেড়াচ্ছ; তাদের পেছনে ধাওয়া করছে প্রাইড অফ লায়ন আমাকে তারা বেশ জোর করে গাড়ির ভেতরে আটকে রাখলো। নতুবা খুব কাছে যেয়ে এই দৃশ‍্য দেখার সুযোগ আমি হারাতাম না। সাধারণত, অধিকাংশ মাংসাশী আক্রমণই বৃথা যায়। কারণ, বিবর্তনের মাধ‍্যমে সবসময়ই শিকারগুলো শিকারীর তুলনায় দ্রুত গতি অর্জন করতে থাকে। সিংহকে বলা হয় আফ্রিকার কন্ট্রোলার। এক সিংহ হারিয়ে গেলে পুরো জঙ্গলের জীব বৈচিত্রের ভারসাম‍্যই বিনষ্ট হয়ে যাবে। 


খানিকটা দূরে যেয়ে আমাকে আরেকবার থমকে দাঁড়াতে হলো। এবার আমাদের পথ আগলে রেখেছে এক দল উটপাখি। আফ্রিকায় এই একমাস থাকার পর আমি কীভাবে আবার অক্সফোর্ডে ফেরৎ যাবো তা বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে তখন জঙ্গলের নেশায় ধরে বসেছে। 


উটপাখি খুবই বদজাত পাখি। এরা মানুষ দেখলেই আক্রমণ করে। আপনি হয়তো ভাবছেন তারা এসে আপনাকে ঠোকর দিবে। কিন্তু, খুবই অবাক করে তারা অসম্ভব শক্তিশালী ফরোয়ার্ড কিক বা জোরসে লাথি মারে। উপরন্তু উটপাখির সাথে দৌড়েও পারা সম্ভব নয়। তাই আমাকে শিখিয়ে দেয়া হলো, উটপাখি আক্রমণ করলে বড় কোন গাছের পেছনে গিয়ে লুকোচুরি খেলতে হবে। আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করতে থাকলাম, এই হলো সেই সাভানা যেখানে আদিম মানুষ প্রথম সভ‍্যতার সূচনা ঘটিয়েছিলো। সাপের কামড়, উটপাখির লাথি খেয়ে বেঁচে থাকা এই প্রজাতিটা আজকে তাদের ইলেকট্রিক গাড়ি ফ‍্যালকন রকেটে বসিয়ে মঙ্গল গ্রহে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমার মতে, মানব সভ‍্যতার এই বিবর্তনকে কদর করতে না পারাটা অসম্ভব মূর্খতার নির্দশন। 


অবশেষে আমি আর মন দ্বিতীয় লোকেশনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মন ফাঁদ পাতলো; আর আমি ছবি তুলে তুলে ল‍্যান্ড মার্ক মনে রাখার চেষ্টা করলাম। জঙ্গলের গাছের গায়ে দাগ কেটে কেটে কোন রকমে নিজেদের পদচিহ্ন ফেলে যাচ্ছি। আজ রাতটা আমরা কাটাবো এই অজানা বনের ভেতরে। হয়তো কোন এক আর্ডভাক আমাদের জালে ধরা পড়বে।


দুপুর দুইটা নাগাদ আমরা ফেরত গেলাম বেস ক‍্যাম্পে। কেট আমাদের জন‍্যব্রিটিশ লাঞ্চএর ব‍্যবস্থা করেছে। ফিলিপআর্ডভাক কখন ধরা পড়বে?’ সেই উত্তরের উপর ভিত্তি করে বেটিং শুরু করেছে। আমি রাত্র :১৫ থেকে ১০:১৫ মিনিটের উপর বাজি চাললাম। এরপর কেট আর আমার মধুর এক গল্পের সূচনা হলো। আমার জীবনের গল্প শুনে কেট বললো, “আমি তোমাকে আমার মেয়ের সাথে একবার দেখা করিয়ে দিতে চাই। সে তোমার মতো গ্লোবাল সিটিজেনে পরিণত হয়েছে। এখন সে ক‍াম্বোডিয়ার বস্তিতে কাজ করতে গিয়েছে।আমি আমার ইমেইলটা লিখে দিয়ে বললাম, “নিশ্চয়ই।


বিকেলের বাকী অংশটা আমরা হাসি তামাশায় কাটিয়ে দিলাম। আস্তে আস্তে সন্ধ‍্যা নামলো। ড‍্যান একা চলে গেলো প্রথম ফাঁদের কাছে। আমি আর মন ফোর হুইলার চালিয়ে গেলাম দ্বিতীয় ফাঁদে। চার ভেট বসে থাকলো বেস ক‍্যাম্পে। এখন আমাদের একমাত্র ভরসা রেডিও সিগনাল।


গাড়ি পার্ক করে দুটো চেয়ার পেতে আমি আর মন আফ্রিকান রাতের আকাশের নীচে বসে আমাদের ছয় ঘন্টার মধুর গল্প শুরু করলাম। মন আমার কাছে অবাক হয়ে শুনতে চাইলো বাংলাদেশের ছাত্রের অক্সফোর্ড গমনের গল্প। আমি মনের কাছে শুনতে চাইলাম তার আফ্রিকার জঙ্গলে বাস করার ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা। পর্যায়ে আমি জানতে পারলাম ব‍্যারির কথা। ব‍্যারি ড‍্যানের বন্ধু। সাত পাইন্ট বিয়ার খেয়ে সে একবার কিং কোবরা ধরতে বনে গিয়েছিলো। যখন কোবরাটা সে খুঁজে বের করলো তখন বুঝতে পারলো তার সব সরঞ্জাম গাড়িতে ফেলে এসেছে। অবশেষে খালি হাতে আফ্রিকান কোবরা ধরার দু:সাহসিক অভিযান চালিয়ে সেব‍্যারি দ‍্য ব্রেইভখ‍্যাতি অর্জন করেছে।


এভাবে গল্প-হাসি-তামাশায় কাটলো আমাদের পরবর্তী চার ঘন্টা। রাত্র সাড়ে দশটায় আমাদের রেডিওতে প্রথম মেসেজ আসলো। মন লাফিয়ে উঠে ভাবলো, আর্ডভাক ধরা পড়েছে! কিন্তু, না। এই মেসেজ পাঠিয়েছে ড‍্যান। সেই মেসেজের মর্মার্থ হলো, “There is a hippo.”


মনের মুখটা ফ‍্যাকাশে হয়ে গেলো। কারণ, জলহস্তির আক্রমণে প্রতি বছর আফ্রিকায় কুমিড়ের তুলনায় বেশী মানুষ মারা যায়। অসম্ভব বৃহদাকার এই প্রাণী মানুষ দেখলেই তেড়ে আসে এবং পায়ে চাপে পিষ্ট করে। মন সাথে সাথে গাড়িতে লাফিয়ে উঠলো। আমরা গেলাম ড‍্যানকে উদ্ধার করতে। 


প্রথম ফাঁদের কাছে যেয়ে আমরা লাইট নিভিয়ে দিলাম। অন্ধকার রাতে প্রায় এক ঘন্টা হাঁটার পর বুঝতে পারলাম, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। অগত‍্যা বাধ‍্য হয়ে লাইট জ্বালাতে হলো। এই লাইট জ্বালানোর বিশ মিনিটের মাথায় জঙ্গল আলোড়িত করে বড় সড় কিছু একটা আমাদের দিকে তেড়ে আসতে লাগলো। আমি আর মন ভয় পেয়ে গাড়ির দিকে দৌড় দিলাম। পেছনের জন্তুটা একটু পর চিৎকার করে বললো, “I am going to kill you, bastards. Don’t leave me.” 


লাইট দেখে আসলে ড‍্যানই ঘাসের মাঝে হামাগুড়ি দিয়ে চলে এসেছে আমাদের কাছে। গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্টের পর ভম ভম করে সেই এলাকা থেকে বের হয়ে আসলাম। এবার শুরু হলো কাহিনী বর্ণণা। ঘটনা খুবই হাস‍্যকর। আমার গত জন্মদিনে বন্ধু ইফতি স্টিফেন হকিং সাহেবের লেখা “Brief Answer to the Big Questions” বইটা উপহার দিয়েছিলো। বইটি আমি সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম আফ্রিকায়। ড‍্যান সেই বই আমার কাছ থেকে ধারে নিয়েছিলো পড়বার জন‍্য। ফাঁদের পাশে বসে মহাবিশ্বের বড় প্রশ্নের উত্তর জানতে জানতে বন্ধু ড‍্যান গভীর ঘুমে লুটিয়ে পড়েছিলো। তার ঘুম ভাঙ্গে জলহস্তির হাঁটার শব্দে। ততক্ষণে আর পালাবার উপায় নেই। গত দুই ঘন্টা ধরে ড‍্যান মরার মতো জলহস্তি থেকে দশ হাত দূরে পড়ে ছিলো। 


আমি ড‍্যানের এই গল্প শুনে হাসি থামিয়ে রাখতে পারলাম না। আমার অট্টহাসিতে ব্রেক পড়লো হঠাৎ; মন কষেছে সেই হার্ডব্রেক। কারণ, একদল কুডু আমাদের গাড়ির সমানে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। নেপালে আমাদের রাস্তার সামনে গরু বসে থাকতো; আফ্রিকায় থাকে কুডু। সবই মানিয়ে নেয়ার ব‍্যাপার।


রাত্র সাড়ে বারোটায় দ্বিতীয় ফাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা তিনজন। বুঝতে পারলাম, আজও হয়তো ভাগ‍্য সহায় হবে না। যখন আমি আর মন জাল খুলতে শুরু করলাম ঠিক তখনই গর্তের ভেতরে শুরু হলো গর গর আওয়াজ। ড‍্যান টর্চ মেরে দেখতে পারলো কুঁচকুঁচে কালো সেই আর্ডভাকটাকে। সাথে সাথে ভেটকে সিগনাল পাঠানো হলো, “চলে আসো কিন্তু, ততক্ষণে রাত একটা বাজে। It’s too late for surgery.


বিশ্ববিদ‍্যালয়ের নিয়ম অনুসারে, আমাদেরকে ছেড়ে দিতে হলো সেই আর্ডভাক। তবে মন এবার একটু আত্মবিশ্বাসী। সেই গর্তের মুখে মোশন সেন্সর ক‍্যামেরা লাগিয়ে আমরা ফিরে গেলাম প্রেটোরিয়া বিশ্ববিদ‍্যালয়ে। স্বপ্ন শেষে যেন আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। 

 

ডিপার্টমেন্টের সামনে Shamir Montazid লেখা বড় বড় তিনটা বাক্স পড়ে আছে। আজ রবিবার। ড‍্যান তার বান্ধবীর কাছে চলে গেলো। আমি বাক্সগুলো খুলে আফ্রিকার বুকে গড়ে তুললামহাইজেনবার্গের ল‍্যাব পরদিন সকাল নয়টায় শুরু হলো আমাদের এক্সপেরিমেন্ট। প্রথম তিনদিন আমরা ২১ ঘন্টা টানা কাজ করেছি। ভোর পাঁচটায় বাসায় ফিরে সকাল আটটায় আবার ল‍্যাবে হাজির হয়েছি। ড‍্যান আমাকে দেখলেই বলতো, “Shamir, long time, no see!”


কোন রকম সাপ্তাহিক ছুটি না নিয়েই কাজ করলাম টানা ২১ দিন। মাঝখানে একদিন বস সাজিয়াকে স্কাইপ করে দেখালাম আমাদের রেজাল্ট। সবার চক্ষু তখন চড়ক গাছ। নেইকেড মোল র‍্যাট ইজ দ‍্য আন্সার। সেটা বিস্তারিত বলার জন‍্য আজ থেকে দশ বছর পর একটা বই লিখবো।


এই শত শত এক্সপেরিমেন্টের মাঝে কোন কোন দিন দুপুরে এসে ড‍্যানের বান্ধবী ক‍্যারেন আমাদেরকে নিয়ে যেতো নতুন কোন পাবে। আমি একে একে চেখে দেখতাম বন‍্য প্রাণীর স্টেক। পৃথিবীর অন‍্যান‍্য দেশে মাংস বলতে সবাই গরু, মুরগী আর শূকরকেই বুঝে। আফ্রিকার রেঁস্তোরার মেন‍্যুতে আছে উটপাখি, ইম্পালা, কুডু সহ নাম-না-জানা আরো কত কী? আমি আজ পর্যন্ত সেই কুডুর স্বাদ ভুলতে পারিনি। মাংসটা খেতে অনেকটা গরুর মাংসের মতো; তবে চর্বিগুলো মাংস থেকে আলাদা একটা স্তরে থাকে। সেই চর্বি আগুনে পুড়িয়ে মুখে দিতেই কচ কচ করে গলে যাবে; আর আপনি পৌঁছে যাবেন স্বাদের স্বর্গে।


প্রেটোরিয়াতে অবশেষে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয়ে যায় ব‍্যারি। ইয়েস! সেই ব‍্যারি দ‍্য ব্রেইভ। আমরা আগস্ট ব‍্যারির জন্মদিন উদযাপন করতে গেলাম। রেস্তোরায় আমি একমাত্র অসাদা মানুষ বসে আছি। আবারো বুঝতে পারলাম যে, সাদা কালো বিভাজনটা এতোটাই প্রকট যে, কালোরা সাদাদের দোকানে খেতেও আসে না। ব‍্যাপারটায় আমি একটু বিরক্ত হলাম। ব‍্যারি আমাকে নিয়ে গেলো Fock Off নামক একটা ক্লাবে। অবশেষে কিছুটা বর্ণবৈষম‍্য হ্রাস পেলো। ব‍্যারি অ‍্যান্ড দ‍্য গ‍্যাং এর কাছ থেকে আমি শিখতে পারলাম সাউথ আফ্রিকান সংস্কৃতি সম্পর্কে। বাংলাদেশের মতো সাউথ আফ্রিকাতেও মানুষ ডেইট করে শুধু বিয়ে করার জন‍্য; এরাওয়ান নাইট স্ট‍্যান্ডসংস্কৃতিতে খুব একটা অভ‍্যস্ত না। ব‍্যারি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি একটা বিয়ে করে আফ্রিকায় থেকে যাও।” 


আমি বললাম, ‘আফ্রিকায় থাকতে চাই। তাই বলে আত্মহত‍্যা করতে চাই না।


এভাবে চোখের পলকেই কেটে গেলো আফ্রিকায় আমার প্রথম ২৪ টি দিন। প্রটোরিয়ায় কাজ করতে করতে যখন আমি খুব হতাশ হয়ে যেতাম তখনই ল‍্যাবের বাইরে একটা বেঞ্চে বসে আফ্রিকান আপেল আর কফি খেতে খেতে গাছের উপর বসে থাকা বিশাল বড় সাইজের অজানা কিছু পাখির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এই মুহুর্তে বার্সেলোনা শহরের এক কফিশপে বসে আমি তাকিয়ে আছি একটা গাছের দিকে। সেখানে বসে আছে কাক; নেই কোন আর্ডভাক।


We belong to Africa. I belong to Africa. 





Contact

Hi there! Please leave a message and I will try my best to reply.

© 2024 Shamir Montazid. All rights reserved.
Made with love Battery Low Interactive.