মরুভূমির অমর প্রাণী
Apr 26, 2025 | 100
সময়টা তখন ১৯৬০-এর দশক। দক্ষিণ আফ্রিকার আটলান্টিক সাগরের তীরবর্তী শহর কেপটাউনের এক তরুণ জীববিজ্ঞানী জেনিফার জার্ভিস তখন গবেষণা করছিলেন আফ্রিকান মোল-র্যাটের কয়েকটি প্রজাতির ওপর। তার গবেষণার মধ্য দিয়ে আমরা সর্বপ্রথম জানতে পারি, ইঁদুরের মত দেখতে ছোট্ট এই স্তন্যপায়ীরা মাটি খুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে গেরিলার মতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাফেরা করে; মাটির ওপর জনসম্মুক্ষে খুব একটা সময় কাটায় না। আফ্রিকার জিবুতি, কেনিয়া, সোমালিয়া আর ইথিওপিয়ার মরু অঞ্চলের মাটির নীচে প্রায় এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে নির্মিত এসব সুড়ঙ্গে বাস করে মোল-র্যাটদের এক একটি কলোনি।
জেনি জার্ভিস খুবই অবাক হয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন, আফ্রিকান মোল-র্যাটদের মাঝে দুটি প্রজাতি রয়েছে যারা মৌমাছির মতো সমাজব্যবস্থায় বসবাস করে। প্রতিটি কলোনিতে প্রায় ৭০-৮০ জন সদস্য থাকে। কলোনির সবচেয়ে অতিকায় স্ত্রী মোল-র্যাটটি ‘রাণী’র ভূমিকা পালন করে। বাকি মোল-র্যাটরা হলো তার কর্মী। এদর কাজ কলোনি পাহাড়া দেয়া, মাটি খুঁড়ে খাবার সংগ্রহ করা, এবং শিশু মোল-র্যাটদের লালনপালন করা। অন্যদিকে শুধুমাত্র রাণী এবং ২-৩ জন ভাগ্যবান পুরুষ মোল-র্যাট কলোনীতে বংশবিস্তারের কাজ করে। কোন পুরুষেরা প্রজননের এই সৌভাগ্য অর্জন করবে তাও শুধুমাত্র কলোনির রাণী মোল-র্যাটটি নির্ধারণ করে। কোন কারণে রাণীর মৃত্যু হলে বড় আকারের স্ত্রী কর্মীরা নিজেদের মাঝে মারামারি করে। অতঃপর যুদ্ধে বিজয়ী স্ত্রী মোল-র্যাটটি কলোনিতে নতুন রাণীর মর্যাদা লাভ করে। স্তন্যপায়ীদের জগতে কেবল মাত্র দুটি প্রজাতি রয়েছে যারা মৌমাছির মতো এরকম সমাজ ব্যবস্থায় বাস করে। এ দুটি প্রজাতিই মোল-র্যাটের প্রজাতি। একটির নাম ডামারাল্যান্ড মোল-র্যাট, অপরটি নেকেড মোল-র্যাট।
বিজ্ঞানী জেনিফার তার প্রিয় দুই শিক্ষার্থীকে এই দুটি প্রজাতির উপর গবেষণার দায়িত্ব দিলেন। তাদের মধ্যে রশেল বাফেনস্টেইন কাজ শুরু করলেন নেকেড মোল-র্যাট নিয়ে; আর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী নাইজেল বেনেটকে দায়িত্ব দেয়া হল ডামারাল্যান্ড মোল র্যাটের জীবনরহস্য উদঘাটনের। বাফেনস্টেইন ১৯৭৪ সালে কেনিয়ার মরুভূমিতে গর্তখুড়ে বেশ কিছু নেকেড মোল-র্যাট ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে এলেন। নিজের ল্যাবের ভেতর শুরু করলেন নেকেড মোল-র্যাটের কলোনি উৎপাদনের প্রক্রিয়া। প্লাস্টিকের বড় বড় পাইপ জোড়া লাগিয়ে ল্যাবের ভেতর তৈরি করা হলো সুড়ঙ্গ,ঠিক যেমনটা মরুর মাটিতে মোল-র্যাটগুলো তৈরি করত। ল্যাবে বানানো এসব পাইপের সুড়ঙ্গে বসবাস করতে শুরু করলো বাফেনস্টেইনের নেকেড মোল-র্যাটের নতুন কলোনি। আপনি নিশ্চয় ভাবছেন, এদের নাম ‘নেকেড’ মোল-র্যাট কেন? মানুষ বাদে কোন প্রাণীই তো জামা পরে না, তবে শুধু এই মোল-র্যাটগুলোই উলঙ্গ উপাধি পেল কেন? কারণ, তাদের চামড়া প্রায় সম্পূর্ণ লোমহীন। পুরো শরীর জুড়ে হাতেগোণা মাত্র ১০০টির মতো লোম থাকায় মাত্র ৩৫ গ্রাম ওজনের এই ক্ষুদে প্রাণীটি দেখতে একটা লোমহীন বিমর্ষ ইঁদুরের মতো। তাদের গায়ের চামড়া জন্মের পর পরই কুচঁকিয়ে ঝুলে থাকে। প্রথম দর্শনে মনে হবে এরা যেন বার্ধক্যের যাতনায় পিষ্ট!
কিন্তু, বিজ্ঞানী বাফেনস্টেইন যখন তার ল্যাবে মোল-র্যাটের কলোনি উৎপাদন করছিলেন, তখন তিনি লক্ষ করলেন একেবারে অপ্রত্যাশিত কিছু বৈশিষ্ট্য! প্রথমত, প্রতি কলোনিতে মাত্র একটি রাণী বাচ্চা জন্ম দিলেও সেটি একের পর এক গর্ভবতী হতে পারে। প্রতি গর্ভাবস্থায় সে ১১-১৩টি শাবকের জন্ম দেয় এবং বছরে ৫ বার পর্যন্ত গর্ভবতী হতে পারে। জন্মের পর ৮ থেকে ১১ মাসের মধ্যে তারা বংশবিস্তার শুরু করতে পারে (ইঁদুরের সেজন্য অপেক্ষা করতে হয় মাত্র দেড় মাস)। একটা ইঁদুরের তিন বছরের জীবনে সে মাত্র আট মাস বয়স পর্যন্ত প্রজনন করে। ৭৩ বছরের জীবনে মনুষ্যসমাজের স্ত্রী সদস্যরা গড়ে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত সন্তান জন্ম দিতে পারে। মধ্যবয়সে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাঝে পরিলক্ষিত এই বন্ধ্যাত্বকে বলা হয় ‘মেনোপজ’। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, নেকেড মোল-র্যাটের কোন মেনোপজ হয় না। সেই আট মাস বয়স থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা প্রজননে সক্ষম। এখন প্রশ্ন হলো, এই নেকেড মোল-র্যাটরা বাঁচে কতদিন?
একটা প্রাণীর আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা যে জটিল ব্যাপার, সেটা কিন্তু আমরা প্রথম অধ্যায়েই আলোচনা করেছি। প্রফেসর বাফেনস্টেইন সেই জটিল কাজটিই করে ফেললেন। বছরের পর বছর ধরে তার কলোনিতে জন্ম নেয়া নেকেড মোল-র্যাটদের বিশদ জীবন ইতিহাস তিনি নোটবুকে টুকে রাখলেন। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে থাকলেও তার ল্যাবের মোল-র্যাটরা খুব একটা মারা গেলো না। কালে ভদ্রে গুটি কয়েক মোল-র্যাট নিজেদের মাঝে মারামারি করে মারা যেতো।
এভাবে প্রায় বিশ বছর পেরিয়ে গেলো। বাফেনস্টেইনের মোল-র্যাটগুলো ল্যাবের পাইপ-সুড়ঙ্গে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাফেন্সটেইনও নোটবুকে লিখেই যাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই বিশ বছরে তাদের শরীরে তেমন কোন পরিবর্তন নাই। মোল র্যাটদের হাড়ের গড়ন বুড়ো বয়সেও আগের মতোই রয়েছে। তারা পুরো দমে প্রজনন চালিয়ে যাচ্ছে; এমনকি তাদের কোষের ভেতরকার কার্যকারিতাও যৌবনের হারে চলছে। চামড়া যতটাই কুঁচকে যাক না কেনো এই মোল-র্যাটদেরকে বার্ধক্য যেন স্পর্শ করতেই পারছে না। বাফেনস্টেইন বুঝতে শুরু করলেন, আফ্রিকার মুরুভূতিতে তিনি আসলে এক স্বর্ণের খণি খুঁজে পেয়েছেন। হতে পারে, এরাই সেই প্রাণী যারা অমরত্ব অর্জন করতে পেরেছে।
২০০২ সালে প্রফেসর বাফেনস্টেইন ঘটা করে সারাবিশ্বকে জানিয়ে দিলেন, তার ল্যাবের একটি নেকেড মোল-র্যাট ২৮ তম জন্মদিনের কেক কেটেছে। এ ঘোষণার ফলে ইঁদুর গোত্রের (রোডেন্ট) সকল প্রজাতির মাঝে নেকেড মোল-র্যাট সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রাণীর মর্যাদা লাভ করলো। পরবর্তীতে অবশ্য ৩৭ বছর বয়সী নেকেড মোল-র্যাটের সন্ধানও পাওয়া যায়। তবে আমরা যদি পরিসংখ্যানবিদদের মতো করে কাপলান-মেয়ার কার্ভ (প্রথম অধ্যায়) তৈরি করি, তবে দেখতে পাবো ৮০% নেকেড মোল-র্যাট ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচে, যা রোডেন্ট বা ইঁদুর গোত্রের প্রাণী হিসেবে তার প্রত্যাশিত আয়ুষ্কালের ৫ গুণ বেশি! এবং এই বিশাল জীবনটায় আপাতদৃষ্টিতে তারা বার্ধক্যজনিত কোন জটিলতায় ভুগে না বললেই চলে।
একদিকে দীর্ঘজীবি রোডেন্ট, তার উপর বার্ধক্যজনিত রোগ নেই, ওদিকে আবার অসাধারণ প্রজনন ক্ষমতা। বুঝতেই পারছেন, কয়েক দশকে বিজ্ঞানী বাফেনস্টেইনের ল্যাব নেকেড মোল-র্যাটে ভরে গিয়েছিল। আগের অধ্যায়ে আমরা জেনেছিলাম, ইঁদুর এবং মানুষের মাঝে প্রতি চারজনে একজনের ক্যান্সার হয়। কিন্তু বাফেনস্টেইন তার ৮০০ মোল-র্যাট গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেও ক্যান্সারের কোন উপশম দেখতে পেলেন না। তিন বছর বেঁচে থাকা ইঁদুরের ক্যান্সারের অভাব নেই, অথচ ২৫-৩০ বছর বেঁচে থাকা মোল-র্যাটরা প্রায় ক্যান্সারশূণ্য । নেকেড মোল র্যাটের কলোনিতে ক্যান্সারের এই অপ্রতুলতা তখন বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে নিল। ধীরে ধীরে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ল্যাব থেকে নেকেড মোল-র্যাট প্রবেশ করতে শুরু করে মলিকুলার বায়োলজির ল্যাবে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করলেন নেকেড মোল-র্যাটদের ক্যান্সারবিহীন জীবনের রহস্য উদঘাটনের। এদিকে বিজ্ঞানী বাফেনস্টেইন তার বিশ্বজোড়া খ্যাতি এবং নেকেড মোল-র্যাটের কলোনি নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে বসতি গড়লেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে। তার গবেষণায় আগ্রহী হয়ে গুগল প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ‘ক্যালিফোর্নিয়া লাইফ সায়েন্স নামক এক নতুন কোম্পানি গঠন করলো। সবাই উঠে পড়ে লাগলেন নেকেড মোল র্যাটের চিরতরুণ জীবনের রহস্য খুঁজতে।
জিনোম রহস্য উন্মোচন
২০১১ সালে নিউয়র্কের ব্রড ইন্সটিটিউটের গবেষকরা সর্বপ্রথম নেকেড মোল-র্যাটের ডিএনএ সিকুয়েন্স উন্মোচন করেন। এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীর গবেষকরা শুধুমাত্র কম্পিউটারের ব্রাউজার ব্যবহার করে এই প্রাণীটির ডিএনএ-তে সঞ্চিত তথ্য পর্যালোচনা করার সুযোগ পায়। আপনিও যদি এই কাজটি করতে ইচ্ছুক হন তবে www.ncbi.nlm.nih.gov সাইটে যেয়ে যে কোন প্রাণীর ডিএনএ-তে সঞ্চিত তথ্য ঘেঁটে দেখতে পারেন। আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে কোষ বিভাজন নিয়ন্ত্রণের জন্য অ্যাকসেলারেটর এবং ব্রেক প্রোটিনের কথা আলোচনা করেছিলাম। এরকম কয়েকটি ব্রেক প্রোটিন (যারা কোষ বিভাজনে বাধা দেয়ার মাধ্যমে ক্যান্সার সৃষ্টির সম্ভাবনা হ্রাস করে) হলো p15, p16, এবং p27. বিস্ময়ের ব্যাপার, নেকেড মোল-র্যাটের ডিএনএ-তে এই তিনটি প্রোটিনের পাশাপাশি pALT নামক একটি অতিরিক্ত ব্রেক প্রোটিনের রেসিপি পাওয়া গেলো। তাই তখন ধারণা করা হলো, এই pALT প্রোটিনের কারসাজিতেই হয়ত নেকেড মোল-র্যাট ক্যান্সারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম।
কুঁচকে থাকা ত্বকের রহস্য
২০১৩ সালে আমেরিকার রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ভেরা গর্বুনোভা ঘটা করে নেচার পত্রিকায় প্রকাশ করলেন তাদের প্রথম বিস্ময়কর আবিষ্কার। তারা নেকেড মোল-র্যাটের ত্বক কেন বুড়োদের মতো কুঁচকে থাকে তা নিয়ে জানতে আগ্রহী ছিল। সে উদ্দেশ্যে তারা প্রাণীটির ত্বক থেকে কোষ নিয়ে ল্যাবের প্লাস্টিকের প্লেটে চাষ করতে লাগল। প্রতিদিন সকালে তারা ল্যাবে এসে দেখত, প্লেটের মধ্যকার তরল মিডিয়া (যাতে কোষের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার দেয়া থাকে) ঘোলাটে হয়ে গেছে।
প্রথম দিকে সবাই বেচারা পিএইচডি ছাত্রটাকে দোষারূপ করতো। মনে করত সে কোষের প্লেটে অসাবধানতাবশত ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে দিয়েছে, যার ফলে মিডিয়া পচে ঘোলা হয়ে গেছে। কিন্তু, যখন গর্বুনোভা বার বার তার ল্যাবের প্লেটের মিডিয়া ঘোলা হয়ে যেতে দেখলেন তখন সেই মিডিয়ার মাঝে কোন পদার্থ জমা হচ্ছে তা সনাক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরিশেষে তারা নিশ্চিত হল যে তাদের মিডিয়াতে আসলে কোন ব্যাকটেরিয়াই নেই; বরং নেকেড মোল-র্যাটের কোষ থেকে হাই-মলিকুলার-ম্যাস-হায়ালুরোনিক-এসিড (আসুন সংক্ষেপে আমরা একে ডাকি হায়ালুরোনান) নামক এক পদার্থ নি:সরিত হচ্ছে। এই হায়ালুরোনান কোষের প্রাচীর থেকে বাহিরের দিকে ঝুলে থাকে। কোন একটি কোষে মিউটেশনের কারণে ক্যান্সারের সূচনা হলে তখন প্রতিবেশী কোষের pALT, হায়ালুরোনান এবং CD44 নামক আরেকটি প্রোটিন একসাথে হয়ে ক্যান্সার সম্ভাবী কোষটিকে শুরুতেই মেরে ফেলে। এই ঘটনাকে বলা হয় Early Contact Inhibition. এর ফলশ্রুতিতে ক্যান্সার কোষ তার মিউটেশন নিয়ে বিভাজনের মাধ্যমে পুরো অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে না।
একই পেপারে গর্বুনোভার দল দেখালেন আরেক চমক। মলিকুলার বায়োলজির ল্যাবে গবেষণার খাতিরে ইঁদুর কিংবা মানুষের কোষের অ্যাকসেলারেটর এবং ব্রেক প্রোটিনের রেসিপিতে ইচ্ছাকৃতভাবে মিউটেশন সৃষ্টি করে ক্যান্সার তৈরি করা যায়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য ইঁদুরের কোষে যেখানে মাত্র দুটি প্রোটিনে মিউটেশন সৃষ্টি করাই যথেষ্ট; সেখানে নেকেড মোল-র্যাটের একসাথে চারটি প্রোটিনের মিউটেশন না হলে ক্যান্সারের সূচনা করা যায় না। প্রকৃতিতে তাদের জীবদ্দশায় একই কোষের চার চারটি প্রোটিন মিউটেশন হয়ে ক্যান্সার সৃষ্টির সম্ভাবনা তাই অতিনগণ্য। গর্বুনোভার দলের এই আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা নেকেড মোল-র্যাটের ক্যান্সার ফাঁকি দেবার আণবিক পদ্ধতি (মলিকুলার মেকানিজম) জানতে পারলাম।
নেকেড মোল-র্যাটের ক্যান্সার হয় না— এটা একটি বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষন। আর নেকেড মোল-র্যাটের হায়ালুরোনানের কারণে তার ক্যান্সার হয় না— এটি সেই পর্যবেক্ষনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। যখন আমরা একটি জিনিসের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা জানতে পারি তখন আমরা সেই তথ্যকে মানবকল্যাণে ব্যবহার করতে পারি।
এ পর্যায়ে ত্বকের যত্নে সচেতন পাঠকদের একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি। আমি যখন ওপরে হায়ালুরোনিক এসিডের কথা বলেছি তখন আপনাদের মাঝে কেউ কি তাদের মুখে মাখার সিরামের বোতলটা হাতে নিয়ে দেখেছেন? ত্বকের যত্নে ব্যবহৃত সিরামে এখন প্রচুর হায়ালুরনিক এসিডের ব্যবহার হয়। এই পদার্থটি ক্যান্সার প্রতিরোধের পাশাপাশি ত্বকের মোলায়েমভাব বজায় রাখে। এধরণের গবেষণার ফসল তাই আপনারা ইতোমধ্যেই উপভোগ করতে শুরু করেছেন।
নেকেড মোল-র্যাটের তারুণ্যের রহস্য কি অন্য প্রাণীতে প্রতিস্থাপন সম্ভব?
২০১৩ সালের পর থেকে ভেরা গর্বুনোভার দল তাদের হায়ালুরোনানের আবিষ্কারকে সরাসরি মানব কল্যাণে প্রয়োগের উপায় খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু যেকোন আবিষ্কার মানুষে প্রয়োগের পূর্বে ল্যাবের অন্যান্য প্রাণী যেমন ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করে নিশ্চিত হতে হয় যে এর কোন বাজে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তাই গর্বুনোভার দল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে নেকেড মোল-র্যাটের হায়ালুরোনান এর ডিএনএ ইঁদুরের ডিএনএ-তে ঢুকিয়ে দিল। তারপর মাসের পর মাস সেই ইঁদুরগুলোকে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে দেখল। অবশেষে ২০২৩ সালে তারা আবারো নেচার পত্রিকায় ঘটা করে তাদের ফলাফলগুলো প্রকাশ করলেন। সে ফলপ্রকাশে দেখা গেল, নেকেড মোল-র্যাটের জিনধারী ইঁদুরের প্রায় সকল অঙ্গেই প্রদাহ বা inflammation কমে গিয়েছে। এই প্রদাহ আমাদের বার্ধক্যের পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
আরও দেখা গেল হায়ালুরোনান-জিনধারী ইঁদুরগুলোর পরিপাকতন্ত্রে মিউকাস নি:সরণ বেড়ে গিয়েছে, যা তাদেরকে খাদ্যজাত ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। এর পাশাপাশি পরিপাকন্ত্রের স্টেমসেলে দেখা গেলো আরেক বিস্ময়। হায়ালুরোনান-ধারী বয়স্ক ইঁদুরগুলো সময়ের সাথে তাদের স্টেমসেল থেকে বিভাজনের মাধ্যমে অন্যান্য কোষ তৈরির সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেনি, যা কিনা বার্ধক্যের অন্যতম কারণগুলোর একটি। গর্বুনোভার দলের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, তাদের এই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করা ইঁদুরগুলো সাধারণ ইঁদুরের তুলনায় ১২% বেশী সময় ধরে বাঁচল। অর্থাৎ, নেকেড মোল-র্যাটে আবিষ্কৃত শুধুমাত্র একটি জিন ইঁদুরের দেহে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে তাদের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। এভাবে দীর্ঘজীবী প্রাণীর ওপর গবেষণা চালিয়ে গেলে হায়ালুরোনান এর মতো আরো অনেক উপকারী জিনের সন্ধান পাওয়া সম্ভব।
ইঁদুরের আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে আমাদের কী লাভ?
আমাদের সরাসরি কোন লাভ নেই। এই গবেষণার মাধ্যমে আমরা শুধু এইটুকু নিশ্চিত হলাম যে, নেকেড মোল-র্যাটের একটি বৈশিষ্ট্য অন্যকোন জীবে ঢুকানো হলে সেই জীবের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পায় এবং তার স্টেমসেল চিরতারুণ্য ধরে রাখতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়ায় মানবদেহের ভেতর অন্য প্রাণীর ডিএনএ ঢুকানো সম্ভব নয়, কারণ বর্তমান বিশ্বে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে সুস্থ মানুষের ডিএনএ-র পরিবর্তন করা অধিকাংশ দেশই অবৈধ। তাহলে আমরা কীভাবে এই দীর্ঘ জীবনের স্বাদ আস্বাদন করতে পারবো?
আশার কথা হলো, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করাই কারো দেহে হায়ালুরোনান প্রতিস্থাপন করার একমাত্র উৎস নয়। বিজ্ঞানীরা এখন নেকেড মোল-র্যাটের বিশেষ এই হায়ালুরোনানকে ল্যাবের ভেতর ব্যাপকভাবে তৈরি করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হয়তো কয়েক বছরের মাঝে তা ইঞ্জেকশন কিংবা ট্যাবলেট ভরে মাধ্যমে মানবদেহে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। যদি প্রাথমিক বিচারে তা কোন নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে, তবে আগামীতে বৃহত্তর জনসংখ্যার ওপর (সম্মতিসাপেক্ষে) হায়ালুরোনান প্রয়োগ করে মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির চেষ্টা করা হতে পারে। সুতরাং, আগামী এক দশকের মাঝেই হয়তো শুধু রোগমুক্তি নয়, বরং আয়ু বৃদ্ধির ওষুধও আমরা বাজারে দেখতে পাবো। আমরা আজ দাঁড়িয়ে আছি চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক রোমাঞ্চকর সময়ে!
বাফেনস্টেইন-জেনি জার্ভিসদের কী হলো?
এই অধ্যায়ের শুরুতে আমি দুজন বিজ্ঞানীর কথা বিশদভাবে বর্ণণা করেছিলাম, যারা আফ্রিকার মরুভূমির মাটি খুড়ে নেকেড মোল-র্যাটের ওপরে গবেষণার সূচনা করেছিলেন। এর মাঝে বিজ্ঞানী রশেল বাফেনস্টেইন বর্তমানে আমেরিকার ইলিনয়িস শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। তিনি তার ৫০ বছরেরর গবেষণার ওপর ভর করে এখন প্রায়ই বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে থাকেন। অন্যদিকে প্রফেসর জেনি জার্ভিস ২০১৬ সালের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পূর্বে তার দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা নেকেড মোল-র্যাটের কলোনিতে গবেষণা চালিয়ে যাবার জন্য সেটি তারপ্রিয় ছাত্র প্রফেসর নাইজেল বেনেটকে উপহার হিসেবে দান করেন। সেই প্রফেসর বেনেটের ছাত্র, সাউথ আফ্রিকার নবীন প্রাণিবিদ ড্যানিয়েল হার্ট নিজ গাড়িতে করে প্রায় শতাধিক নেকেড মোল-র্যাটকে কেপ টাউন থেকে প্রেটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে নিয়ে আসেন। সেখানে সূচনা ঘটে নেকেড মোল-র্যাট গবেষণার আরেকটি নতুন অধ্যায় ।
ব্রিটিশ বিজ্ঞানী বেনেট দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। তবে প্রায়ই তিনি লন্ডনের কুইন মেরী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতে আসেন। ২০১৮ সালের এক গ্রীষ্মকালে লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়ামে তার দেখা হয়ে যায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্সার গবেষক ড. সাজিয়া ইরশাদের সাথে। একে ওপরের কাজ সম্পর্কে আলাপের পর তারা একসাথে নেকেড মোল-র্যাটের চিরতরুণ জীবনের রহস্য খোঁজার জন্য একটি বৈজ্ঞানিক বন্ধুত্বের সূচনা করেন ।
স্টেম সেল গবেষণায় নেকেড মোল র্যাট
প্রফেসর বেনেট বেশ কিছুদিন ধরেই লন্ডনের কুইন মেরী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ক্রিস ফক্সের সাথে নেকেড মোল-র্যাটের স্টেম সেল নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তারা যুবক এবং বয়স্ক নেকেড মোল-র্যাটের ত্বকে একটি ধারালো যন্ত্র দিয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে তাদের সেই ক্ষয় পূরণের প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার জন্য কিছুদিন ল্যাবের মাঝে রেখে দিলেন। আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি যে, আমাদের দেহে কোন ক্ষত সৃষ্টি হলে সে অঙ্গে বিদ্যমান স্টেমসেলগুলো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষতটি পূরণ করে। যৌবন বয়সে এ প্রক্রিয়া কাজ করলেও বুড়ো বয়সে স্টেমসেলের সঞ্জীবনী শক্তি কমে আসে। আমরা আলোচনা করেছিলাম, এ কারণেই একটি বাচ্চা খেলতে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেললে তা পরে জোরা লেগে যায় কিন্তু বয়স্ক ব্যক্তির হাড় ভাঙ্গলে তা সহজে জোরা লাগে না। প্রফেসর বেনেট এবং ফক্স তাদের ল্যাবে অবাক হয়ে দেখলেন, যুবক এবং বয়স্ক নেকেড মোল-র্যাটগুলো তাদের চামড়াতে সৃষ্ট ক্ষতকে একই সময়ের মাঝে পূরণ করতে পারছে। এর মানে হলো, বয়সের সাথে নেকেড মোল-র্যাটের স্টেমসেল তাদের সঞ্জীবনী ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে না; ধরে রাখে তাদের তারুণ্য।
এ ছিলো নেকেড মোল র্যাটের স্টেমসেল গবেষণার সূচনা মাত্র। ২০১৮ সালে প্রফেসর বেনেটের সহকর্মী ডা. সাজিয়া ইরশাদের প্রথম পিএইচডি ছাত্র হিসেবে আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নেকেড মোল-র্যাটের ওপর কাজ শুরু করি। ২০১৯ সালের গ্রীষ্মকালে আমি চলে যাই সাউথ আফ্রিকার প্রেটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে প্রফেসর বেনেটের ছাত্র ড্যানিয়েলের সাথে মিলে আমরা শুরু করি নেকেড মোল-র্যাটের স্টেমসেল গবেষণার একটি নতুন অধ্যায়। আমাদের প্রাথমিক ধারণা ছিলো, যেকোন দীর্ঘজীবী প্রাণীর স্টেমসেল ধীরে ধীরে বিভাজিত হয়। নতুবা কোষ বিভাজনের হেইফ্লিক লিমিটের কারণে টেলোমিয়ার হ্রাস পেয়ে তাদের স্টেমসেল খুব অল্প বয়সেই বিভাজন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। এই ধারণাটা কি এই ক্ষুদে মোল-র্যাটের জন্যেও সত্যি? এই ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্য আমরা তাদের দেহের ভেতর স্টেমসেল বিভাজনের হার বের করতে উঠে পড়ে লাগলাম।
স্টেমসেল বিভাজনের হার নির্ধারণ
একটা জ্বলজ্যান্ত প্রাণীর শরীরের মাঝে কোষ বিভাজনের হার নির্ধারণ করাটা একটু কঠিন ব্যাপার। কারণ এর জন্য একটি বিশাল সময় জুড়ে কোষের বিভাজনকে কোন এক উপায়ে আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান করতে হবে। এই কাজটি করার উদ্দেশ্যে আমরা একটি বুদ্ধি বের করলাম। আমরা জানি কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ-র নতুন কপি সৃষ্টি হয়। এই কপি তৈরির জন্য প্রতিটি কোষ অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থাইমিন, সাইটোসিন নামক চারটি অণু ব্যবহার করে। আমাদের গবেষণাগারে এমন একটি বিশেষ রঙ (ব্রোমো-ডিঅক্সি ইউরিডিন) রয়েছে যা কোষ বিভাজনের সময় থাইমিনের বদলে ডিএনএ-র মাঝে যুক্ত হয়ে তাকে রাঙিয়ে তুলতে পারে। মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে বিভাজনরত স্টেমসেলের মাঝে এই রঙের উপস্থিতি দেখা যায়। তাই, এই রঙটিকে আমরা নেকেড মোল-র্যাটের শরীরে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রতি আট ঘন্টা পর পর প্রয়োগ করতে থাকলাম। ৫ দিন ধরে প্রায় ৩৫ টি মোল-র্যাটের ওপর আমি আর ড্যানিয়েল চালাতে থাকলাম এই ইঞ্জেকশন।
এক্সপেরিমেন্টের এক পর আমরা দেখলাম, বৃহদান্ত্রের মাত্র ১৮% স্টেমসেল রঙিন হয়ে উঠেছে। সময়ের সাথে রঙিন স্টেমসেলের পরিমাণ বাড়তে থাকলো এবং ৫ দিনের মাথায় প্রায় ৭১% স্টেমসেল রঙটি প্রদর্শন করতে থাকলো। এবার শুধুমাত্র ডিএনএতে যুক্ত হওয়া রঙ দেখে আমরা স্টেমসেলের বিভাজন হার নির্ধারণ করলাম। কাঠখোট্টা সূত্রটি হল:
কোষ বিভাজন হার = (০.৭১-০.১৮)/(৫-১) = ০.১৩ বিভাজন/দিন
সহজ ভাষায় বললে, প্রতিদিন নেকেড মোল-র্যাটের বৃহদান্ত্রের স্টেমসেলগুলো একটি বিভাজনের মাত্র ১৩% সম্পন্ন করে। ফলে সেই স্টেমসেলের একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাজন হতে সময় লাগে ১/০.১৩ = ৭.৫ দিন। এদিকে মানুষের স্টেমসেলের বিভাজনে সময় লাগে ৭.২ দিন। অন্যদিকে ইঁদুরের লাগে মাত্র ২ দিন। সুতরাং আমরা বিশ্বকে প্রমাণ করে দেখালাম, মানুষ কিংবা নেকেড মোল-র্যাটের মত দীর্ঘজীবী প্রাণীগুলোর স্টেমসেল ধীরে ধীরে বিভাজিত হয়।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে নেচার কমিউনিকেশন্স পত্রিকায় আমাদের এই আবিষ্কারের কথা প্রকাশিত হলো। বিশাল এক ফ্রোরোসেন্স মাইক্রোস্কোপের নীচে আমার তোলা ডিএনএর সেই অদ্ভুত রঙিন ছবিগুলো এই পেপারের অংশ হল। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব জানতে পারলো, দীর্ঘজীবী প্রাণীরা বিবর্তনের মাধ্যমে স্টেমসেলের বিভাজন হার কমিয়ে এনেছে। তবে ঠিক কোন নিয়ন্ত্রক প্রোটিনের কারসাজিতে নেকেড মোল-র্যাটের স্টেমসেল তাদের বিভাজনের হারকে কমিয়ে রাখে তা আমাদের এখনো অজানা। আগামী বছরগুলোতে সেই পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারলে আমরাও হয়তো এই আবিষ্কারেরর ফলাফল মানুষের দেহে প্রয়োগ করে সুফল পেতে পারবো।
কিন্তু, শুধু ধীর কোষ বিভাজনের ফলে কি হিসাব মিলে?
আমরা আগের অধ্যায়ে জেনেছি নেকেড মোল-র্যাটরা গড়ে ২৫ বছর বাঁচে। এই মাত্র আমরা জানলাম তাদের বৃহদান্ত্রের স্টেমসেলগুলো প্রতি ৭.৫ দিনে একবার বিভাজিত হয়। তাহলে তাদের সম্পূর্ণ জীবদ্দশায় প্রতিটি স্টেমসেল মোট কয়বার বিভাজিত হবে?
৭.৫ দিনে বিভাজিত হয় = ১ বার
০১ দিনে বিভাজিত হয় = ১/৭.৫ বার
২৫ বছরে বিভাজিত হয় = (২৫×৩৬৫)/৭.৫ বার = ১২১৬ বার
অর্থাৎ, স্টেম সেলের বিভাজনের হার কমিয়ে আনার পরেও নেকেড মোল র্যাটের জীবদ্দশায় প্রতিটি স্টেমসেল গড়ে প্রায় ১২০০ বার বিভাজিত হবে। বিজ্ঞানী হেইফ্লিকের কথামতে, একটি কোষের ৫০ বিভাজনেই তার ডিএনএ-র লেজের ডগায় অবস্থিত টেলোমিয়ার ফুরিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে ১২০০ বিভাজনের সময় নেকেড মোল র্যাটের ডিএনএর-র একটা বড় অংশই তো পলিমারেজের আলসেমির কারণে ডিএনএ কপি করার সময় হারিয়ে যাবার কথা। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে এই স্টেমসেলগুলোর পক্ষে ১২০০ বার বিভাজন করা তো অসম্ভব হওয়া কথা। তবুও নেকেড মোল-র্যাটের স্টেমসেলগুলো কোন সমস্যা ছাড়াই নিজের তারুণ্য ধরে রেখে বিভাজিত হতে পারছে। ব্যাপারটা একটু বেমিল মনে হচ্ছে, তাই না?
এই অঙ্কের হিসেবটা মেলালেন অবশেষে আমাদের প্রফেসর নাইজেল বেনেট আর তার বন্ধু ড. ক্রিস ফক্স মিলে। তারা ৬ মাস থেকে ২০ বছর বয়সী নেকেড মোল-র্যাটের টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য মাপতে গিয়ে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন যে, বয়সের সাথে প্রাণীটির টেলোমিয়ার ছোট তো হচ্ছেই না বরং খানিকটা বড় হয়েছে। এর অর্থ হলো, প্রতি কোষ বিভাজনের সময় পলিমারেজের ভুলের কারণে যে টেলোমিয়ারটুকু হারিয়ে যাবার কথা নেকেড মোল-র্যাটে তা আবার পুনরায় গজিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, কীভাবে?
অধিকাংশ স্তন্যপায়ীদের কোষেই আসলে টেলোমিয়ার পুনঃনির্মাণের একটি প্রক্রিয়া সচল থাকে। বিভাজনরত কোষে টেলোমারেজ নামক একটি প্রোটিন আরো কয়েকটি প্রোটিনের সহায়তায় পলিমারেজের ভুলের কারণে ডিএনএ থেকে ক্ষয় হয়ে যাওয়া টেলোমিয়ারটি আবার তৈরি করে ফেলে। ইঁদুর এবং মানুষের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এই প্রক্রিয়াটি ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু, প্রফেসর বেনেটদের গবেষণার ফলে আমরা জানতে পারি, নেকেড মোল-র্যাটে এই প্রক্রিয়াটি শেষ বয়স পর্যন্ত সচল থাকে। এর পেছনের কারণটি খুঁজে বের করেছেন আমেরিকার সেই ভেরা গর্বুনোবার দল। তারা প্রমাণ করেছেন, টেলোমিয়ার পুন:নির্মাণের জন্য নিয়োজিত প্রোটিনগুলোর মাঝে অন্যতম TINF2 নামক প্রোটিনটি তৈরির রেসিপি (জিন) স্তন্যপায়ীদের ডিএনএ-তে মাত্র ১ কপি থাকে। অন্যদিকে নেকেড-মোল র্যাটের ডিএনএ-তে TINF2 প্রোটিনটি তৈরীর জিনের দুই দুটি কপি থাকে যা ব্যবহার করে তারা হয়তো নিজেদের টেলোমিয়ার শেষ বয়স পর্যন্ত গজিয়ে নিতে পারে। সুতরাং, স্টেমসেল বিভাজন হ্রাসের পাশাপাশি টেলোমিয়ার পুনঃনির্মাণের মাধ্যমে নেকেড মোল-র্যাট তাদের বার্ধক্য প্রতিরোধ করতে পারে।
এ অধ্যায়ে আমরা ল্যাবের গবেষণায় ব্যবহৃত প্রাণীদের মাঝে অন্যতম দীর্ঘজীবী প্রজাতি নেকেড মোল-র্যাটের ক্যান্সারবিহীন সুস্থ জীবনের পেছনকার গল্প উন্মোচন করলাম। আগামী অধ্যায়ে আমরা এই ছোট্ট নেকেড মোল-র্যাট থেকে এক লাফ দিয়ে স্থলচরের সবচেয়ে বড় প্রাণীটির জীবনে ঢুকে পড়বো। কীভাবে ৭০ বছর আয়ুষ্কালের হাতি ক্যান্সারকে এড়িয়ে পুরো জীবন কাটিয়ে দেয় সে গল্পটা আমরা উদঘাটন করবো এক সাথে।
———————————————————————————
সূচিপত্র:
- পূর্বকথা
- আমাদের আয়ুষ্কালের ইতিহাস
- বুড়ো জীবনের যতো সমস্যা
- প্রকৃতির মাঝে অমরত্বের সন্ধান
- মরুভূমির অমর প্রাণী
- ঐরাবতের বিবর্তনে বাজিমাত
- দু’শো বছরের তারুণ্য
- ধীর গতির সেঞ্চুরিয়ান
- নর্দমার ফিনিক্স
- শেষকথা
———————————————————————————
ই-বইটি পড়ে ভালো লেগে থাকলে লেখক ও প্রকাশকের কথা চিন্তা করে অনুগ্রহপূর্বক বইটির কপি সংগ্রহ করুন এই লিংক থেকে: রকমারি.কম