মিসোজেনি অন দ্য টেবিল
Social Issues

মিসোজেনি অন দ্য টেবিল

Dec 24, 2021   |    5131


বছর খানেক আগের কথা। আমার বান্ধবী হেলেনার পিএইচডি শেষ হয়েছে। বিলেতি ডিগ্রী লাভের আতিশয্যে আমার বাভারিয়ান মিতা আমাকে পেটচুক্তি খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে এক বাংলাদেশী রেঁস্তোরায় নিয়ে গেলো। আমার পেটের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের সাথে অসামঞ্জস‍্যপূর্ণ পরিমান গরুর গোস্ত আর পরোটা অর্ডার করা হলো। খাবার শেষে এক গ্লাস কোক খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে না তুলতেই ওয়েটার এসে আমার সামনে বিলটা দিয়ে গেলো। যেহেতু হেলেনা আমাকে আপ্যায়ন করবে বলে নিয়ে এসেছে, সেহেতু আমি বিল খানা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। সে খানিকটা অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো


“Shamir, why did the waiter just assume that you are going to pay the bill?” 


আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরে ব‍্যাপারটা চিন্তা করলাম। সারা জীবন যতবার বান্ধবীসমেত খেতে গিয়েছি ততবারই বিলটা আমার কাছে এসেছে। বান্ধবী আমার থেকে বেশী টাকা উপার্জন করলেও আমার দেশী ওয়েটার ভাই তাদের বিল দেওয়ার দু:সাহস দেখাতে যায়নি। কারণ সেই কিশোর বেলা থেকে শুনেছি— “মেয়েদের হাত ধরে রাস্তা পার করে দিতে হয়। রেঁস্তোরায় তাদের জন্য দরজা ধরে, চেয়ার টেনে দিতে হয়। মেয়েদেরকে ভারী জিনিস বহন করতে দিতে হয় না। মেয়েদের বিল দিতে দেওয়াটা ঠিক না। ইত্যাদি ইত্যাদি…” 


ব্যাপারটা এতোটাই গুরুতর যে, এই কাজগুলোকে ভদ্রতার রেওয়াজে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু কেন?


হেলেনা আর আমি সেই ওয়েটারের আচরণের পেছনকার কারণ অনুমান করতে লাগলাম গতবছর যখন অতি সামান‍্য সময়ের জন‍্য ঢাকায় ঘুরতে এসেছিলাম তখন কয়েকজন বান্ধবীর সাথে বিভিন্ন রেঁস্তোরায় খাওয়ার সময় এই অনুমানগুলো পরীক্ষা করতে লেগে পরলাম। এই ব্লগে সেই অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণণা করা হলো


অনুমান-: যে অর্ডার দেয়, ওয়েটার তাকেই বিল দেয়। যেহেতু আমি অর্ডার দিয়েছি, তাই ওয়েটার আমাকে বিল দিয়েছে। 

আমি এবং বান্ধবী মিলে গুলশানের এক অভিজাত রেঁস্তোরায় গেলাম। প্রথম দিন আমি অর্ডার করলাম। খাবার শেষে বিলটা ওয়েটার আমাকে দিয়ে গেলো। পরদিন একই রেঁস্তোরায় আমরা আবার গেলাম। অন‍্য একজন ওয়েটারের কাছে এবার বান্ধবী অর্ডারটা দিলো। খাবার শেষে বিলটা আসলো আমার কাছেই। সুতরাং, অর্ডার যেই দিক না কেন বিলটা ছেলেটার কাছে দেওয়া হয়।


অনুমান-: ওয়েটাররা অনেক ব্যস্ত। কে অর্ডার দিয়েছে তা সে মনে রাখতে পারে না। খাওয়া শেষ হবার পর যে বিলটা চায়, ওয়েটার তাকেই বিলটা দিবে। 

আমি এবং বান্ধবী এবার বনানী-১১ তে অবস্থিত এক আলিশান রেঁস্তোরায় পর পর দুইদিন খেতে গেলাম। প্রতিদিনই অর্ডার দিয়েছে বান্ধবী। খাবার শেষে প্রথম দিন আমি ওয়েটারের কাছে বিলটা চাইলাম। সে আমাকে বিল দিয়ে গেলো। দ্বিতীয় দিন বান্ধবী (নতুন) ওয়েটারের কাছে বিল চাইলো। ওয়েটার বিলটা আমাকেই দিয়ে গেলো। ফলশ্রুতিতে বান্ধবীকে আবারো হতে হলো লিঙ্গ বৈষম‍্যের শিকার। 


অনুমান-: ওয়েটার যখন বিলটা নিয়ে আসে তখন যে তার সাথে চোখ-চাহনি বজায় রাখে সে তাকেই বিল দেয়। 

আমি এবং বান্ধবী এবার চলে গেলাম ধানমন্ডির স্বনামধন‍্য বার্গারের দোকানে। যথারীতি পরপর দুই দিন এই কাজ করা হলো। এই বার দুই দিনই বান্ধবী অর্ডার দিলো এবং খাবার শেষে বান্ধবীই বিলটা দিয়ে যেতে বললো। প্রথমদিন ওয়েটার যখন বিলটা নিয়ে আসছিলো তখন আমি তার দিকে চোখে-চোখ রেখে তাকিয়ে রইলাম। সে আমাকে বিলটা দিয়ে গেলো। দ্বিতীয়দিন বান্ধবী এই কাজটা করলো। ওয়েটার বন্ধু হালকা ইতস্তত করে তারপর আমাকেই বিলটা দিয়ে গেলো। সুতরাং, ওয়েটারের দিকে যেই তাকিয়ে থাকুক না কেন, শুধু পুরুষ মানুষটাই বিল দেয়ার যোগ‍্য। 


অনুমান-: ওয়েটার যখন বিল নিয়ে আসে তখন যার মানিব্যাগ টেবিলের উপর রাখা থাকে সে তাকেই বিল দেয়। 

আপনি বুঝতেই পারছেন এবার কি হতে যাচ্ছে। আমি আর বান্ধবী গুলশান- এর কফিশপে গেলাম পর পর দুই দিন। দুই দিনই বান্ধবী অর্ডার দিলো, বান্ধবী বিল দিতে বললো এবং ওয়েটার বিল নিয়ে আসার সময় বান্ধবী তার দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রথম দিন আমি আমার মানিব‍্যাগটা বের করে টেবিলের উপর রাখলাম। বিলটা আমার সামনে দেয়া হলো। দ্বিতীয়বার বান্ধবী তার টাকার ব‍্যাগটা বের করে টেবিলে রাখলো। বিলটা আমাকেই দেয়া হলো। সুতরাং, বিল পাওয়ার সম্মানটা শিশ্নধারণক্ষমতার সাথে বেশ শক্তভাবে জড়িত।


অনুমান-: বয়স হলো প্রধান নিয়ামক। যাকে দেখতে বেশী বয়সি মনে হয়, ওয়েটার তাকেই বিল দেয়। 

এইবার আর বান্ধবী নিয়ে কাজ হবে না। আমি আর মাজননী চলে গেলাম খিলগাঁওয়ের এক দোকানে কাচ্চি বিরিয়ানী খেতে। মাজননী অর্ডার করলো, বিল চাইলো (চোখা-চোখির ব‍্যাপারটা খুব একটা করা গেলো না) যথারীতি বিল আসলো আমার কাছেই। সুতরাং, নারী বয়সে বড় হলেও তার কাছে অর্থকড়ির বিষয়গুলো দেয়া হলো না। 


অনুমান-: ছেলেদেরকে বিল দেয়াটা মূলত বাংলাদেশী রেওয়াজ। এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ।

আমি আর হেলেনা অক্সফোর্ডের বেশ কিছু ইউরোপিয়ান রেঁস্তোরায় খেতে গেলাম। প্রতিটি দোকানে খাবার শেষে ওয়েটার জিজ্ঞাসা করে—“তোমরা বিলটা একসাথে দিবে না আলাদা-আলাদা করে দিবে?” তখন আমরা তাকে বলে দেই আজকের বিলটা কে দিচ্ছে। সে তাকেই বিলটা এনে দেয়। কিন্তু, লন্ডনের বাংলাদেশী দোকানে গেলে বিলটা আবার শুধুমাত্র আমার কাছেই আসা শুরু করে। সুতরাং, এই মিসোজেনি (misogyny, নারীদের অবদমিত রাখার সংস্কৃতি) অন্তত আমাদের সমাজে দেখা যায়। হয়তো আমাদের কাছাকাছি সংস্কৃতির দেশ ভারত, পাকিস্তানেও এই ঘটনা ঘটবে


অনুমান-: শামীর একজন পক্ষপাতদুষ্ট ব‍্যক্তি। যেহেতু সে নারীবাদী, সেহেতু সে এই বিষয়গুলোকে অতিরঞ্জিত করে লেখার চেষ্টা করেছে।

খুবই শক্তিশালী একটা অনুমান। আমার এই প্রতিটি অভিজ্ঞতার কিছু চরম সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেগুলোকে এখানে লিপিবদ্ধ করলাম

সীমাবদ্ধতা-: প্রতিটি ঘটনার বান্ধবী একই নয়। প্রতিদিনই বান্ধবীর বদল হয়েছে।

সীমাবদ্ধতা-: প্রতিটি ক্ষেত্রেই মাত্র একবার পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। সত‍্যিকার ঘটনা বুঝতে হলে এই কাজগুলো হাজার হাজার বার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে তারপর সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াটা সমুচিত।

সীমাবদ্ধতা-: প্রতিদিনই রেঁস্তোরা বদল হয়েছে। আদর্শ পরীক্ষা করতে হলে একই রেঁস্তোরায় একই বান্ধবী সাথে নিয়ে এই কাজগুলো করে দেখা উচিত। তবে এই বুদ্ধিটিরও একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একই ওয়েটার প্রতিদিন অর্ডার নিতে আসলে সে মুখ চিনে ফেলে। একসময় সে বান্ধবীকেই বিল দিতে শুরু করে। আমাদের এই সামাজিক পরীক্ষায়ও তাই দেখা গেছে। বেশ কয়েকটি রেঁস্তোরায় একই ব‍্যক্তি দুই-তিন দিন ধরে অর্ডার নিলে সে আগের দিন যে বিল দেয় পরদিন তাকেই এসে বিলটা দিবে। সুতরাং, এই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতটা চাইলেই অতিক্রম করা যায়। আপনাকে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।


এই রকম সীমাবদ্ধতা অনুমান আরো হাজারটা লেখা যাবে। আমি এইখানেই খ‍্যামা দিলাম। আমার ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে বলতে পারি, আমরা মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাটাকে এখনো সমাজে খুব বেশী গ্রহণযোগ‍্য করে তুলতে পারি নাই। আমাদের দেশে অনেক মেয়েই অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু, তারা তাদের প্রাপ‍্য সম্মানটুকু পান না। রেঁস্তোরায় বিল দেয়ার এই পর্যবেক্ষণটুকু খুবই সামান‍্য একটি ব‍্যাপার। এটা লক্ষ‍্য করতে পারলে ভবিষ‍্যতে আপনার বাসার কাজের বুয়া তার বেতন দিয়ে কেন মাদকাসক্ত স্বামীকে ইয়াবা কিনে দেয় তাও বুঝতে পারবেন। আপনি আরো গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখবেনআপনার বাসার অতন্ত মেধাবী মেয়েকে আপনি বিদেশে একা পিএইচডি করতে যেতে দিতে চান না; বিসিএসের চাকুরি নিয়ে নেত্রকোণায় যেতে দিতে চান না। তাকে বিয়ে দিয়ে জামাইসহ পাঠিয়ে দিতে চান। কারণ, আপনার মেয়ে যে একজন স্বনির্ভর ব‍্যক্তি তা মানতে আপনিই অপারগ।


সতর্কবাণী: এই ব্লগ কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র নয়। সুতরাং, আমার কথা বিশ্বাস করার কোন দরকার নেই। চাইলে আপনি এই কাজগুলো আপনার জীবনে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পারেন। হয়তো আপনি আমার সাথে একমত হবেন, হয়তো ভিন্নমত প্রদর্শন করবেন। আপনি যে দলেরই হোন না কেন, আমি আপনাকে শ্রদ্ধা সম্মান করবো। কারণ, এই পুরো প্রক্রিয়াটি করার মাধ‍্যমে আপনি আপনার মস্তিষ্ককে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ করার একটা ক্ষুদ্র ট্রেনিং দিলেন।




Contact

Hi there! Please leave a message and I will try my best to reply.

© 2024 Shamir Montazid. All rights reserved.
Made with love Battery Low Interactive.